কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্যের চাকরিপ্রার্থী এবং শিক্ষার্থীদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ রায় ঘোষণা করল। এতদিন পর্যন্ত শুধুমাত্র জেনারেল ক্যাটাগরির প্রার্থীরাই EWS (Economically Weaker Section) সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে পারতেন। কিন্তু নতুন রায় অনুযায়ী, এখন থেকে OBC (Other Backward Class) প্রার্থীরাও চাইলে EWS সার্টিফিকেট নিতে পারবেন। পশ্চিমবঙ্গে EWS সার্টিফিকেটের গুরুত্ব সর্বাপেক্ষা বেশি কারণ পশ্চিমবঙ্গে EWS প্রার্থীর সংখ্যা অনেক কম। তবে শর্ত থাকছে—OBC সুবিধা তারা আর ব্যবহার করতে পারবেন না। আদালতের এই সিদ্ধান্তকে যুগান্তকারী বলে মনে করা হচ্ছে, কারণ এর ফলে রাজ্যের হাজার হাজার প্রার্থী নতুন সুযোগ পাবেন।

মামলার প্রেক্ষাপট

এর আগে নিয়ম ছিল, যাদের পদবি OBC তালিকাভুক্ত, তারা কখনোই EWS সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে পারতেন না। ফলে অনেক মেধাবী প্রার্থী, যারা OBC কোটার সুবিধা নিতে চাইতেন না এবং আর্থিকভাবে দুর্বল ছিলেন, তারাও এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতেন। এই নিয়মের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলাকারীদের দাবি ছিল—তারা জাতিগত সংরক্ষণ চাইছেন না, তারা শুধু আর্থিক দুর্বলতার ভিত্তিতে সংরক্ষণের সুযোগ চান। আদালত শেষ পর্যন্ত এই যুক্তিকে গ্রহণ করে এবং গুরুত্বপূর্ণ রায় ঘোষণা করে।

হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায়

বিচারপতি অমৃতা সিনহার বেঞ্চ এই মামলায় চূড়ান্ত রায় দেন। রায়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে—

  • এখন থেকে OBC এবং জেনারেল উভয় ক্যাটাগরির প্রার্থীই EWS সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
  • তবে OBC প্রার্থী যদি EWS সার্টিফিকেট নিতে চান, তাহলে তাকে নিজের জাতিগত সংরক্ষণের সুবিধা ত্যাগ করতে হবে।
  • রাজ্য সরকারকে অবিলম্বে তাদের অনলাইন পোর্টাল আপগ্রেড করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে এই নতুন সুবিধা কার্যকর করা যায়।
  • আদালত আরও জানিয়েছে যে, জাতিগত শংসাপত্র (OBC) এবং আর্থিক শংসাপত্র (EWS) দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।

এই রায় কার্যকর হলে রাজ্যের চাকরির বাজারে একটি বড় পরিবর্তন আসতে পারে।

EWS সার্টিফিকেট পাওয়ার শর্ত

কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে, EWS সার্টিফিকেটের জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হবে। আবেদনকারীর পরিবার যদি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে, তবে তিনি যোগ্য হবেন। শর্তগুলির মধ্যে রয়েছে—

  • আবেদনকারীকে অবশ্যই ভারতের নাগরিক হতে হবে এবং রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।
  • পরিবারের বার্ষিক আয় ৮ লক্ষ টাকার কম হতে হবে।
  • পরিবারের কাছে ৫ একরের বেশি কৃষিজমি থাকা চলবে না।
  • ১০০০ বর্গফুটের বেশি ফ্ল্যাট থাকলে আবেদনযোগ্য হবেন না।
  • পৌরসভা এলাকায় ১০০ বর্গগজ এবং গ্রামীণ বা অন্য এলাকায় ২০০ বর্গগজের বেশি আবাসিক প্লট থাকলে আবেদন বাতিল হবে।

এই শর্তগুলি আগেও জেনারেল প্রার্থীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল, এখন থেকে OBC প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও একইভাবে কার্যকর হবে।

EWS সার্টিফিকেটের সুবিধা

EWS সার্টিফিকেটের মাধ্যমে প্রার্থীরা সরকারি চাকরি ও উচ্চশিক্ষায় ১০% সংরক্ষণ পান। এতদিন শুধুমাত্র জেনারেল ক্যাটাগরির প্রার্থীরাই এই সুবিধার আওতায় ছিলেন। কিন্তু এখন OBC প্রার্থীরাও, যদি তারা জাতিগত সংরক্ষণের সুযোগ না নেন, EWS-এর সুবিধা নিতে পারবেন।

এর ফলে প্রতিযোগিতার সুযোগ আরও বাড়বে। যারা আগে OBC কোটার সুবিধা নিতে চাইতেন না, কিন্তু আর্থিকভাবে দুর্বল ছিলেন, তাদের জন্য এটি এক বড় সুবিধা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রায় ভবিষ্যতে চাকরিপ্রার্থীদের একটি বড় অংশকে নতুন দিশা দেখাবে।

প্রভাব ও গুরুত্ব

এই রায় নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। কারণ এতদিন ধরে জাতিগত সংরক্ষণ এবং আর্থিক সংরক্ষণের মধ্যে একটি কড়া বিভাজন ছিল। হাইকোর্টের নির্দেশে সেই বিভাজন অনেকটা কমল। এখন থেকে একজন প্রার্থী নিজের পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন—তিনি জাতিগত সংরক্ষণ নেবেন নাকি আর্থিক সংরক্ষণ নেবেন।

চাকরিপ্রার্থী এবং শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরে এই সুবিধার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অবশেষে আদালতের রায় তাদের সেই সুযোগ এনে দিল। প্রশাসনিক দিক থেকে এটি একটি চ্যালেঞ্জ হবে, কারণ রাজ্য সরকারকে দ্রুত তাদের পোর্টাল ও ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করতে হবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর ফলে বহু প্রার্থী উপকৃত হবেন।

কলকাতা হাইকোর্টের এই রায়ের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে চাকরিপ্রার্থী এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। এখন থেকে OBC প্রার্থীরাও চাইলে EWS সার্টিফিকেট নিয়ে সরকারি চাকরি ও উচ্চশিক্ষায় ১০% সংরক্ষণের সুযোগ পাবেন। তবে এর জন্য তাদের OBC সুবিধা ত্যাগ করতে হবে।

রাজ্যের শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে এই রায় বড় পরিবর্তন আনবে বলে মনে করা হচ্ছে। আদালতের সিদ্ধান্ত শুধু প্রার্থীদের জন্য নয়, গোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই নতুন দিক উন্মোচন করল।