ভারত একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের প্রায় ৫৫% মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত। এক কৃষকদের উন্নতির কথা সর্বাপেক্ষা কেন্দ্র এবং রাজ্য মাথায় রেখেছে। এজন্য কৃষকদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করা হচ্ছে কেন্দ্র সরকারের তরফ থেকে আবার রাজ্য সরকারের তরফ থেকেও। আধুনিক শিল্প বা প্রযুক্তির যুগেও ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি এখনো কৃষিকাজ। তবে জলবায়ুর পরিবর্তন, ফসলের সঠিক দাম না পাওয়া, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এই সমস্ত সমস্যার সমাধানের জন্য এবার কেন্দ্র সরকার এনেছে নতুন কিছু প্রকল্প যার মাধ্যমে কৃষকেরা ভীষণভাবে উপকৃত হবে।
এই প্রেক্ষিতে কেন্দ্র সরকার কৃষকদের আর্থিক সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য একাধিক কল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করেছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকেরা সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাচ্ছেন, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার শিখছেন, এবং ভবিষ্যতের জন্য পেনশন সুবিধাও পাচ্ছেন।
আজ আমরা জানবো কেন্দ্র সরকারের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ কৃষি প্রকল্প সম্পর্কে — যেগুলো বর্তমানে দেশের লক্ষ লক্ষ কৃষকের জীবন বদলে দিচ্ছে।
কৃষকদের উন্নয়নে কেন্দ্রের উদ্যোগ
ভারতের কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রক (Ministry of Agriculture and Farmers Welfare) বিগত কয়েক বছরে কৃষিক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে।
সরকারের লক্ষ্য— কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা, আধুনিক প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়া, ফসলের সঠিক দাম নিশ্চিত করা, এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা।
এই পাঁচটি প্রকল্প সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রধান স্তম্ভ হিসেবে কাজ করছে।
১. প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মান নিধি (PM-Kisan Samman Nidhi)
প্রকল্পের সারসংক্ষেপ:
প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মান নিধি (PM-KISAN) হলো কৃষকদের জন্য ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় আর্থিক সহায়তা প্রকল্প। এটি চালু হয়েছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে, এবং বর্তমানে ১১ কোটিরও বেশি কৃষক এই সুবিধা পাচ্ছেন। এখনো যে সমস্ত কৃষকেরা এই প্রকল্পে আবেদন জানাননি তাদের এই প্রকল্পে আবেদনের সুযোগ দিচ্ছে কেন্দ্র সরকার।
প্রকল্প অনুযায়ী, প্রত্যেক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক বছরে ₹৬,০০০ টাকা পান, যা তিন কিস্তিতে ₹২,০০০ করে সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয় (DBT পদ্ধতিতে)। ইতিমধ্যেই কেন্দ্র সরকার চিন্তা ভাবনা করছে এই প্রকল্পে টাকার পরিমাণ আরো বাড়ানো হবে অর্থাৎ বছরের ৬০০০ এর পরিবর্তে আরও বেশি টাকা পাবেন।
মূল সুবিধা:
- বছরে ₹৬,০০০ টাকা সহায়তা
- সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থপ্রদান (DBT)
- তিন কিস্তিতে টাকা প্রাপ্তি
- চাষের বীজ, সার ও যন্ত্রপাতির খরচ মেটাতে সহায়ক
- স্বচ্ছ ও স্বয়ংক্রিয় পেমেন্ট প্রক্রিয়া
বর্তমান আপডেট:
২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট ১৭টি কিস্তি প্রদান করা হয়েছে এবং সরকারের লক্ষ্য ২০২৬ সালের মধ্যে কৃষকদের সংখ্যা ১২ কোটিতে পৌঁছে দেওয়া।
২. কৃষি উড়ান যোজনা (Krishi Udaan Scheme)
প্রকল্পের সারসংক্ষেপ:
কৃষি উড়ান যোজনা চালু হয় ২০২০ সালে, কেন্দ্রীয় নাগরিক বিমান মন্ত্রক ও কৃষি মন্ত্রকের যৌথ উদ্যোগে।
এর উদ্দেশ্য হলো— কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য যেমন ফল, সবজি, ফুল, দুধ, মাছ ইত্যাদি দ্রুত পরিবহনের মাধ্যমে ন্যায্য দাম ও বড় বাজারে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া।
কীভাবে কাজ করে:
এই প্রকল্পের আওতায় ৫৮টি বিমানবন্দর থেকে কৃষিপণ্য পরিবহন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এর ফলে দূরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কৃষকেরা খুব দ্রুত তাদের পণ্য মেট্রো শহরের বাজারে বিক্রি করতে পারছেন।
মূল সুবিধা:
- কৃষিপণ্যের দ্রুত ও নিরাপদ পরিবহন
- নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস
- দামের উন্নতি ও নতুন বাজারে প্রবেশ
- উত্তর-পূর্ব ও পাহাড়ি অঞ্চলের কৃষকদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী
অতিরিক্ত তথ্য:
২০২5 সালে সরকার Krishi Udaan 2.0 সংস্করণ চালু করেছে, যার মাধ্যমে রপ্তানি সম্ভাবনাও বাড়ছে।
৩. প্রধানমন্ত্রী কৃষক মানধন যোজনা (PM-Kisan Maandhan Yojana)
প্রকল্পের সারসংক্ষেপ:
এই প্রকল্পটি মূলত একটি পেনশন স্কিম, যা কৃষকদের বার্ধক্যে আর্থিক নিরাপত্তা দিতে চালু করা হয়েছে।
২০১৯ সালে এটি চালু করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী কৃষকরা এই স্কিমে যুক্ত হতে পারেন, যেখানে তারা মাসে ₹৫৫ থেকে ₹২০০ পর্যন্ত অবদান রাখেন, এবং সরকার সমান অঙ্কে অর্থ যোগ করে।
৬০ বছর পূর্ণ হলে কৃষক প্রতি মাসে ₹৩,০০০ পেনশন পান।
মূল সুবিধা:
- আজীবন মাসিক ₹৩,০০০ পেনশন
- ১৮–৪০ বছর বয়সী কৃষকদের জন্য উপযুক্ত
- সরকার ও কৃষক উভয়ের সমান অবদান
- বার্ধক্যে স্থায়ী আয়ের উৎস
বিশেষ দিক:
এই প্রকল্পটি দেশের ৪ কোটিরও বেশি কৃষককে পেনশন সুবিধার আওতায় এনেছে, এবং এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কৃষি-পেনশন প্রকল্প।
৪. প্রধানমন্ত্রী কৃষি সেচ যোজনা (PM-Krishi Sinchai Yojana)
প্রকল্পের সারসংক্ষেপ:
২০১৫ সালে চালু হওয়া এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য — “প্রতি ফোঁটা জল, প্রতি শস্যে উপকার”।
দেশের শুষ্ক অঞ্চল, পাহাড়ি এলাকা ও জলস্বল্প অঞ্চলে এই প্রকল্প বিশেষভাবে কার্যকর।
এই প্রকল্পের আওতায় দেওয়া হয়:
- ড্রিপ ইরিগেশন ও স্প্রিংকলার সেচ ব্যবস্থা,
- খাল সংস্কার ও জল সংরক্ষণ,
- এবং ক্ষেত্রের জলে সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ।
মূল সুবিধা:
- আধুনিক সেচ ব্যবস্থা (ড্রিপ ও স্প্রিংকলার)
- জল সংরক্ষণ ও পুনর্ব্যবহার
- উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি
- জল অপচয় হ্রাস
সাফল্য:
এই প্রকল্পের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ৩ কোটি হেক্টর জমি আধুনিক সেচ ব্যবস্থার আওতায় এসেছে।
৫. প্রধানমন্ত্রী ধনধান্য কৃষি যোজনা (PM Dhan Dhanya Krishi Yojana)
প্রকল্পের সারসংক্ষেপ:
এই প্রকল্পটি ২০২৫ সালের ১৬ জুলাই চালু হয়েছে, যা মূলত ১০০টি পিছিয়ে থাকা কৃষি জেলার উন্নয়নকে লক্ষ্য করে।
এটি কৃষি অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ, সংরক্ষণ ও বিপণন সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের আয় বৃদ্ধির দিকেই মনোযোগ দিচ্ছে।
মূল সুবিধা:
- আধুনিক বীজ ও কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ
- প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ
- ফসল সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন
- বাজারে সরাসরি বিক্রির সুযোগ
- পিছিয়ে থাকা জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন
সরকারের লক্ষ্য:
২০২৭ সালের মধ্যে এই প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেক জেলার কৃষকদের আয় ২৫% বৃদ্ধি করা।
৫টি প্রধান কৃষক কল্যাণ প্রকল্পের তুলনামূলক চিত্র
প্রকল্পের নাম | সুবিধার ধরন | আর্থিক সহায়তা / উপকার | লক্ষ্য গোষ্ঠী | বিশেষ বৈশিষ্ট্য |
---|---|---|---|---|
PM-Kisan Samman Nidhi | সরাসরি অর্থ সহায়তা | বছরে ₹৬,০০০ | ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক | ৩ কিস্তিতে DBT মাধ্যমে অর্থপ্রদান |
Krishi Udaan Yojana | পরিবহন সুবিধা | ফসল দ্রুত বিক্রি | উত্তর-পূর্ব ও পাহাড়ি কৃষক | ৫৮টি বিমানবন্দর থেকে পরিষেবা |
PM-Kisan Maandhan | পেনশন স্কিম | মাসে ₹৩,০০০ | ১৮–৪০ বছর বয়সী কৃষক | সরকার ও কৃষক সমান অবদান |
PM-Krishi Sinchai | সেচ অবকাঠামো | জল সংরক্ষণ ও আধুনিক ব্যবস্থা | শুষ্ক অঞ্চল | ড্রিপ ও স্প্রিংকলার ইরিগেশন |
PM Dhan Dhanya | প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ | আয় বৃদ্ধি ও বাজার সহায়তা | পিছিয়ে থাকা কৃষি জেলা | আধুনিক বীজ, সংরক্ষণ ও বিপণন সুবিধা |
আবেদন করার প্রক্রিয়া
যেকোনো কেন্দ্রীয় কৃষি প্রকল্পে আবেদন করার জন্য সাধারণভাবে নিচের ধাপগুলি অনুসরণ করতে হয়:
- অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে যান – যেমন https://pmkisan.gov.in বা https://maandhan.in।
- “New Registration” বা “Apply Now” বাটনে ক্লিক করুন।
- আধার নম্বর, মোবাইল নম্বর ও ব্যাংক তথ্য দিন।
- প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট (যেমন জমির দলিল, কৃষি পাসবুক, ফটো, ব্যাংক পাসবুক) আপলোড করুন।
- আবেদন জমা দিন এবং রসিদ ডাউনলোড করুন।
- পরে আবেদন স্ট্যাটাস চেক করতে পারবেন একই ওয়েবসাইটে।
প্রয়োজনীয় নথিপত্র
- আধার কার্ড
- জমির মালিকানার প্রমাণ
- ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণ
- পাসপোর্ট সাইজ ছবি
- বয়সের প্রমাণপত্র (PM-Maandhan এর ক্ষেত্রে)
- মোবাইল নম্বর
কৃষকের হাতেই ভারতের ভবিষ্যৎ
ভারতের উন্নয়নের মূল ভিত্তি কৃষি। কৃষকদের সুরক্ষা ও আয় বৃদ্ধিই দেশের টেকসই অর্থনীতির চাবিকাঠি। কৃষকদের উন্নতি হলে সর্বাপেক্ষা দেশের উন্নতি হবে।
কেন্দ্র সরকারের এই ৫টি প্রকল্প কেবল আর্থিক সহায়তা নয়, বরং আধুনিক কৃষি, প্রযুক্তি, সংরক্ষণ এবং বাজার ব্যবস্থার এক নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে।
আপনি যদি একজন কৃষক হন বা কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তবে এই স্কিমগুলির মধ্যে এক বা একাধিক প্রকল্পে আবেদন করে সরাসরি উপকৃত হতে পারেন।
“আধুনিক কৃষি, উন্নত ভারত” — এই মূলমন্ত্রেই এগিয়ে চলছে নতুন প্রজন্মের কৃষি উদ্যোগ।

Our team has been engaged in professional content writing for the past 5 years. With extensive experience in creating high-quality, SEO-friendly, and reader-focused articles, we specialize in delivering accurate information on government schemes, education, jobs, technology, and news updates. Our goal is to provide clear, reliable, and engaging content that adds real value to readers while maintaining the highest editorial standards.