ভারতের প্রত্যেক মানুষের কাছে আধার কার্ড আজ এক অপরিহার্য নথি। আধার কার্ড ভারতের মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িত আছে। ভারতের প্রত্যেকটি নাগরিকের আধার কার্ড থাকা বাধ্যতামূল। ব্যাংক থেকে মোবাইল সিম, স্কুল-কলেজ ভর্তি থেকে শুরু করে সরকারি যেকোনো পরিষেবা— সব ক্ষেত্রেই আধার কার্ড প্রয়োজন। ফলে বহু মানুষের ধারণা, আধার কার্ড থাকলেই তিনি ভারতের বৈধ নাগরিক। তবে বাস্তবে কিন্তু সেটা নয়, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করে জানিয়ে দিল, আধার কার্ড নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি নয়। আধার কার্ড থাকলেই আপনি ভারতের নাগরিক হবেন এমন কোন কথা নেই। কেবলমাত্র আধার কার্ড থাকলেই কেউ ভারতের নাগরিক হয়ে যান না। ভারতের নাগরিক থাকতে হলে আপনাকে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় বৈধ নথি থাকতে হবে এবং প্রমাণ করতে হবে আপনি ভারতের নাগরিক। এই মন্তব্যের পর আবারও বিতর্ক তৈরি হয়েছে আধার বনাম নাগরিকত্ব প্রসঙ্গে।

কেন উঠল এই বিতর্ক?

বিহারের খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের সময় এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামনে আসে। অভিযোগ ওঠে, প্রায় ৬৫ লক্ষ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে সমস্ত জল্পনা। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দাবি, আধার নম্বর না থাকার কারণে অনেকের নাম তালিকা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে। এটি মানুষের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করছে বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর বিরোধীরা সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে এবং দাবি তোলে যে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আধার কার্ডকেই একমাত্র প্রমাণ হিসেবে ধরা হোক। এই দাবি নিয়েই শুরু হয় ব্যাপক বিতর্ক এবং শেষ পর্যন্ত বিষয়টি পৌঁছে যায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। এবং সর্বোচ্চ আদালত থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ রায় দেওয়া হয় যেখানে বলা হয় আধারকার্ড থাকলেও আপনি ভারতের নাগরিক নাও হতে পারেন।

আদালতের স্পষ্ট বক্তব্য

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ এই বিষয়ে শুনানি করে স্পষ্ট জানিয়ে দেন— আধার কার্ড কোনোভাবেই নাগরিকত্বের একমাত্র প্রমাণ হতে পারে না। নাগরিকত্বের জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস প্রয়োজন। আধার অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়পত্র, কিন্তু এটি নাগরিকত্ব নির্ধারণের নথি নয়। বেঞ্চ পর্যবেক্ষণ করে জানায়, ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আধার ব্যবহার করা যেতে পারে একটি বিকল্প নথি হিসেবে, কিন্তু একমাত্র আধারকে বাধ্যতামূলক করা আইনসম্মত নয়। তাই পরিচয় পত্র হিসেবে আধার কার্ড ব্যবহার করা যাবে।

আদালতের ভাষায়, “যাচাইয়ের জন্য বহু নথি রয়েছে। আধার তার মধ্যে একটি হতে পারে, কিন্তু একমাত্র প্রমাণ হিসেবে আধারকে ধরা যাবে না।”

আইনি প্রেক্ষাপট

২০১৬ সালের Aadhaar Act–এর ৯ নম্বর ধারা স্পষ্ট জানায় যে, আধার নম্বর বা আধার অথেনটিকেশন নাগরিকত্ব বা বাসিন্দার স্থায়ী পরিচয় প্রমাণ করে না। এটি শুধুমাত্র পরিচয় পত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং ডিজিটাল ইন্ডিয়ার যুগে সমস্ত কাজকর্ম করার জন্য এবং আপডেট থাকার জন্য আধার কার্ড বাধ্যতামূলক। অন্যদিকে, ২০১৮ সালের ঐতিহাসিক পুত্তস্বামী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ জানিয়েছিল— আধার কার্ড নাগরিকত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।

অর্থাৎ আইনের চোখে আধার একটি ডিজিটাল পরিচয়পত্র মাত্র। এর মাধ্যমে নাগরিক সুবিধা পাওয়া সম্ভব, কিন্তু নাগরিকত্ব প্রমাণ করা সম্ভব নয়।

নির্বাচন কমিশনের অবস্থান

নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আইনজীবী রাকেশ দ্বিবেদী যুক্তি দেন, আধারের ব্যবহার ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা রক্ষা করতে সহায়তা করে। কারণ আধারের মাধ্যমে ভোটার কার্ড তৈরি করলে ডুপ্লিকেট বা ভুয়ো নাম বাদ দেওয়া সহজ হয়।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গিয়েছে, বিহারের একাধিক জেলায় আধার–ভোটার লিঙ্কেজের হার ১৪০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়েছে, জাল আধার ব্যবহার করে অনেক অযোগ্য নাম ভোটার তালিকায় ঢুকেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, এইসব জাল আধারের মাধ্যমে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গাদের নাম তালিকায় যুক্ত হয়েছে। তাই কেবল আধার কার্ড থাকলেই কেউ নাগরিক প্রমাণ হবে— এমন দাবি বিপজ্জনক হতে পারে। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের পুজোর পরে শুরু হবে ভোটার তালিকা সংশোধন এখানেও এই সমস্যার কবলে পড়তে পারে পশ্চিমবঙ্গের মানুষজন।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ

আদালত তার নির্দেশনায় জানায়—

  • যাদের নাম ভুলবশত ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে, রাজনৈতিক দলগুলির উচিত তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা।
  • ভোটার তালিকায় নাম যুক্ত করার জন্য আধার ছাড়াও অন্যান্য নথি ব্যবহার করা যাবে।
  • কেবলমাত্র আধার কার্ডকে নাগরিকত্বের চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে ধরা যাবে না।

আধার বনাম নাগরিকত্ব: মূল পার্থক্য

  • আধার কার্ড: একটি পরিচয় নম্বর, যা ভারতের বাসিন্দার নাম, ঠিকানা ও বায়োমেট্রিক তথ্য ধারণ করে। এর আইনি ভিত্তি ২০১৬ সালের Aadhaar Act।
  • নাগরিকত্ব: একটি সাংবিধানিক অধিকার, যা নির্ধারণ করে কে ভারতের বৈধ নাগরিক। এর আইনি ভিত্তি ১৯৫৫ সালের Citizenship Act।

অর্থাৎ আধার প্রমাণ করে আপনি ভারতের বাসিন্দা, কিন্তু এটি প্রমাণ করে না যে আপনি ভারতের নাগরিক।

কেন আধার যথেষ্ট নয়?

১. বিদেশিরাও আধার পেতে পারে – অনুপ্রবেশকারীরা ভুয়ো তথ্য দিয়ে আধার বানিয়ে নেয়, ফলে আধার নাগরিকত্ব নির্ধারণে নির্ভরযোগ্য নয়।
২. আইনের সীমাবদ্ধতা – Aadhaar Act–এর ৯ নম্বর ধারা স্পষ্ট জানায় নাগরিকত্বের প্রমাণ নয় আধার।
৩. আদালতের আগের রায় – পুত্তস্বামী মামলায়ও একই কথা বলা হয়েছিল।
৪. বিকল্প নথির প্রয়োজনীয়তা – জন্মসনদ, পাসপোর্ট, রেশন কার্ড, স্কুল সার্টিফিকেট ইত্যাদি নথিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

কোন কোন নথি নাগরিকত্ব প্রমাণ করে?

ভারতের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য জন্মতারিখ অনুযায়ী ভিন্ন নথি প্রয়োজন হয়—

  • ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ – ১ জুলাই ১৯৮৭: নিজের জন্মসনদ বা স্কুল সার্টিফিকেটই যথেষ্ট।
  • ১ জুলাই ১৯৮৭ – ৩ ডিসেম্বর ২০০৪: নিজের জন্মসনদের সঙ্গে বাবা বা মায়ের নাগরিকত্ব প্রমাণপত্র লাগবে।
  • ৩ ডিসেম্বর ২০০৪-এর পর জন্ম: নিজের জন্মসনদের পাশাপাশি বাবা ও মা উভয়ের নাগরিকত্ব প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক।

এছাড়া ভারতীয় পাসপোর্ট, জাতীয়তা শংসাপত্র, নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসেবে স্বীকৃত।

নাগরিকত্ব প্রমাণে আধারের সীমাবদ্ধতা

আধার নিঃসন্দেহে ভারতের ডিজিটাল পরিচয়ের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সরকারি সুবিধা, ভর্তুকি, আর্থিক লেনদেন— সবকিছুর মূলভিত্তি হয়ে উঠেছে আধার। সরকারি যেকোনো কাজকর্ম করতে গেলে স্কুল কলেজে ভর্তি হতে গেলে আধার কার্ড অপরিহার্য। কিন্তু নাগরিকত্ব প্রমাণের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ আধার বানানো সহজ, এবং বিদেশিরাও ভুয়ো নথি দিয়ে আধার সংগ্রহ করতে পারে। তাই আদালত মনে করে, কেবল আধারকে ভরসা করা বিপজ্জনক হতে পারে।

সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক মন্তব্য আবারও স্পষ্ট করে দিল— আধার একটি পরিচয়পত্র, কিন্তু নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। অর্থাৎ কেউ যদি ভো আধার কার্ড বানিয়ে ভারতের নাগরিকত্ব পেতে চাই তাহলে সেটা বাস্তবে সম্ভব নয়। ভারতের নাগরিক প্রমাণ করতে হলে একাধিক নথি প্রয়োজন, কেবলমাত্র আধার নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটাধিকারের মতো সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করতে হলে বহুমুখী নথির ব্যবহার অপরিহার্য।

অতএব, আধার গুরুত্বপূর্ণ হলেও নাগরিকত্বের একমাত্র মানদণ্ড নয়। ভারতের নাগরিক হতে গেলে জন্মসনদ, পাসপোর্ট, নাগরিকত্ব শংসাপত্রসহ আরও নির্ভরযোগ্য নথি থাকা আবশ্যক। আধার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য পরিচয়পত্র হিসেবে থাকবেই, তবে নাগরিকত্ব প্রমাণে এর ভূমিকা সীমিত।